নিজস্ব সংবাদদাতা: নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে বাড়ছে ততই সহিংসতা। প্রতিদিনই দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। বাদ যাচ্ছেন না সংসদ সদস্য প্রার্থীও। অভিযোগ রয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর এ পর্যন্ত হামলার শিকার ব্যক্তিদের প্রায় সবাই ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপি প্রার্থী। এ ছাড়া প্রার্থীর স্ত্রী-সন্তানদের ওপরও হামলা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারে নামার পর গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে প্রায় ৫০ সংসদ সদস্য প্রার্থী সরাসরি হামলার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএনপির দাবি নির্বাচনী প্রচারের সময় এমপি প্রার্থীদের ওপর বা তাদের গাড়িবহরে দেড় শতাধিক হামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-৮ আসনে বিএনপি প্রার্থী মির্জা আব্বাসের ওপর দুবার, তার স্ত্রী ঢাকা-৯ আসনের প্রার্থী আফরোজা আব্বাসের ওপর তিনবার, নোয়াখালীর (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং নাটোরের সাবিনা ইয়াসমিন ছবির ওপর দুবার করে হামলা হয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাও। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া চৌরাস্তায় হামলায় রক্তাক্ত হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ঢাকা-৩ আসনের প্রার্থী গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। এ ঘটনায় গয়েশ্বর ছাড়াও ২০-২৫ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ যুবদলের সভাপতি মোকাররম হোসেন সাজ্জাদ সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা গণসংযোগের সময় অতর্কিত হামলা চালায়। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে এবং গয়েশ্বরচন্দ্র রায়কে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গয়েশ্বরচন্দ্র রায় ছাড়াও গতকাল মুন্সীগঞ্জে হামলার শিকার হন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য প্রার্থী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। দুর্বৃত্তদের হামলায় গত সোমবার শরীয়তপুরে গুরুতর আহত হন শরীয়তপুর-৩ (ভেদরগঞ্জ-ডামুড্যা-গোসাইরহাট) আসনের বিএনপি প্রার্থী মিয়া নুরুদ্দিন আহম্মেদ অপু। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হামলায় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীরবিক্রম, ফটিকছড়ির তকিরহাটে বিএনপি প্রার্থী কর্নেল (অব) মো. আজিম উল্লাহ বাহারের মাথা ফেটে যায়। প্রতিপক্ষের হামলায় লক্ষ্মীপুর সদরের শান্তিরহাটে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং খুলনায় রকিবুল ইসলাম বকুল আহত হন। একই দিন নোয়াখালী-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী জয়নাল আবদীন ফারুকের ওপর গুলিবর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার রাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে উঠান বৈঠক করার সময় পুলিশের লাঠিপেটায় (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের বিএনপি প্রার্থী মেজর (অব) আখতারুজ্জামান আহত হন বলে প্রার্থীর অভিযোগ। ফেসবুক স্ট্যাটাসে আখতারুজ্জামান লিখেছেন ‘আমার ছেলেকেও মারধর করে গুম করে ফেলতে চেয়েছিল। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমার ছেলেকে বলে দেয় ধানাইপানাই না করে আমরা যেন এলাকা ছেড়ে চলে যাই। গাজীপুরের কালীগঞ্জে গাজীপুর-৫ আসনের বিএনপির প্রার্থী কারাবন্দি ফজলুল হক মিলনের স্ত্রী শম্পা হকের ওপর হামলা হয়েছে। ওই দিন শেরপুরে হামলা হয় বিএনপি প্রার্থী সানসিলা জেবরিন প্রিয়াংকার ওপর। নোয়াখালীর চাটখিলে হামলার শিকার হন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, নাটোরে সাবিনা ইয়াসমিন ছবি। হামলার পর ছবি দেড় ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন। রবিবার রাতে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি সড়কে হামলায় আহত হন মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান সিনহা, তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ সাতজন। উপজেলা যুবদলের সভাপতি শামীম মোল্লা জানান, আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলির কর্মী-সমর্থকরা গতিরোধ করে এ হামলা করে। শনিবার শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার তিনআনীবাজারে শেরপুর-৩ আসনের বিএনপি প্রার্থী মাহমুদুল হক রুবেলের ওপর হামলা করা হয়। ওই রাতে গণসংযোগকালে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশনবাজারে বিএনপি প্রার্থী জিকে গউছের ওপর হামলা করা হয়। গউছের অভিযোগ পুলিশ তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্র্রার্থী জেএম নুরুর রহমান জাহাঙ্গীরের ওপর হামলা হয়। এর আগের দুদিন ঐক্যফ্রন্টের আরও চার প্রার্থী হামলার শিকার হন। ফরিদপুর শহরের চকবাজার চালপট্টিতে গণসংযোগকালে বিএনপি প্রার্থী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের ওপর হামলা করে হেলমেট পরা একদল যুবক। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বান্দেরবাজারে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী ড. রেজা কিবরিয়া, নরসিংদীর শিবপুরের শিমুলিয়া এলাকায় নরসিংদী-৩ আসনের বিএনপি প্রার্থী মনজুর এলাহী, নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার ত্রিমোহনীতে নাটোর-২ আসনের বিএনপি প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন ছবি, মো. দাউদার মাহমুদের ওপর হামলা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ফেনীর সোনাগাজীতে জনসভা শেষে দাগনভূঞায় ফেরার পথে হামলার শিকার হন বিএনপির এমপি প্রার্থী আকবর হোসেন। একই দিন দুপুরে বরিশাল-২ আসনের প্রার্থী সরদার সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টুর গাড়িবহরে হামলা হয়। এতে সান্টুসহ ৩০ জন আহত হন। একই দিন রাজশাহীর বাঘমারায় হামলার শিকার হন বিএনপি প্রার্থী আবু হেনা। ১৬ ডিসেম্বর নরসিংদী-২ আসনে বিএনপি প্রার্থী ড. আবদুল মঈন খানের ওপর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পলাশ উপজেলার পাঁচদোনা বাজারের এ হামলায় অন্তত ১০ নেতাকর্মী আহত হন। এ সময় মঈন খান একটি দোকানে আশ্রয় নেন। ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় প্রচারকালে লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করা হয় ঢাকা-৮ আসনের বিএনপি প্রার্থী মির্জা আব্বাসের ওপর। একই দিন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী বাজারে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষ চলাকালে চাটখিল থানার ওসির গুলিতে নোয়াখালী-১ আসনের (চাটখিল ও সোনাইমুড়ীর আংশিক) প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন গুরুতর আহত হন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে ঐক্যফ্রন্ট এমপি প্রার্থী কর্নেল অলি আহমেদের ছেলে ওমর ফারুকের ওপর হামলা হয়। চাঁদপুর-২ আসনের লুধুয়াবাজারে এমপি প্রার্থী জালাল উদ্দীনের ওপর হামলায় তিনিসহ ১০ জন আহত হন। সিরাজগঞ্জে বিএনপি প্রার্থী রুমানা মাহমুদ তার বাসা থেকে মিছিল নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে যাওয়ার পথে ইবি রোড মোড়ে পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের টিয়ারশেল ও রবার বুলেটে আহত হন রুমানা মাহমুদসহ ২০ জন। রাজধানীর টিকাটুলীতে গণসংযোগকালে হামলা হয় ঢাকা-৬ আসনের ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী ও গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি সুব্রত চৌধুরীর ওপর। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের ওপর হামলার অভিযোগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসনের শাহ রিয়াজুল হান্নানের ওপর হামলা হয়। ওই দিন মানিকগঞ্জ-২ আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বেরিয়ে গাড়িবহর নিয়ে যাওয়ার পথে হামলা হয় বিএনপি প্রার্থী মঈনুল ইসলাম খানের ওপর। নির্বাচন উপলক্ষে ১৩ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের (সোনারগাঁও) আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নির্বাচনে আচরণবিধি সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে সোনারগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কার্যালয়ে মতবিনিময়সভা হয়। ইউএনও শাহীনুর ইসলামের সভাপতিত্বে আট প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় সোনারগাঁও থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনি বিল্লাহ হঠাৎ সভাকক্ষে প্রবেশ করে বিএনপি প্রার্থী আজহারুল মান্নানের গলা চেপে ধরেন। পরে পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। একই দিন যশোর শহরের মুড়–লি জোড়া মন্দির এলাকায় নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধন করতে গিয়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন যশোর-৩ (সদর) আসনের বিএনপি প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা বাধা দিতে গেলে তাদের ওপরও হামলা করা হয়। অনিন্দ্য ইসলাম বলেন, পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা তাকে ছুরি মারতে উদ্যত হলে কর্মীরা রক্ষা করেন। পাবনা-১ (সাঁথিয়া ও বেড়ার একাংশ) আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের গাড়িবহরে হামলা হয়। গত ১২ ডিসেম্বর চাঁদপুর-১ আসনের (কচুয়া) প্রার্থী মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেনের ওপর হামলা হয়। এতে প্রার্থীসহ ৫ জন আহত হন। এ ঘটনার আগের দিন প্রতীক বরাদ্দ শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজ এলাকায় প্রচারে নামলে হামলার শিকার হন। এ ছাড়া হামলায় আহত হন বিএনপি প্রার্থী কিশোরগঞ্জে শরীফুল আলম, সিরাজগঞ্জে ডা. মুহিত, বাগেরহাটে এমএ সালাম, চট্টগ্রামে আজীবুল্লাহ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল নোমান, সাতক্ষীরায় হাবিবুল ইসলাম হাবিব, ঝালকাঠিতে জেবা আমিনা খান, নোয়াখালীতে মোহাম্মদ শাজাহান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অভিযোগ, প্রতিটি হামলার ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত। এসব ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হলেও তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। উল্টো বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (গণমাধ্যম) সোহেল রানা বলেন, যেসব ঘটনার অভিযোগ পাওয়া যায়, এর প্রতিটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্তপূর্বক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কারও যদি এমন অভিযোগ থাকে, পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না তারা ঢালাওভাবে না বলে সুস্পষ্টভাবে পুলিশ সদর দপ্তরেও অভিযোগ দিতে পারেন।