মনির হোসেন (শিশির) :
শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটানোর উদ্দেশ্যে চলতি বছরে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হয়েছে নতুন কারিকুলাম। গতানুগতিক পরীক্ষা থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি, গাইড ও মুখস্থ-নির্ভরতা কমিয়ে শ্রেণি কার্যক্রমে জোর দেয়া হয়েছে নতুন শিক্ষাব্যবস্থায়। তবে শিক্ষাবর্ষের দুই মাস পেরোলেও এখনো এলোমেলোভাবে চলছে নতুন সিলেবাসের পাঠদান।
গত তিন দশকে শিক্ষায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নে বড় ঘাটতি থাকছে, আছে সমন্বয়হীনতা।
দেড় দশক আগে মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। দীর্ঘ সময়েও এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীরা তো দূরের কথা, শিক্ষকদের বড় অংশই তা ঠিকমতো রপ্ত করতে পারেননি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) গত বছরের একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৩৮ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পুরোপুরিভাবে এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এখন এই পদ্ধতি বাদ যাচ্ছে। ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম।
যদিও প্রায় পাঁচ বছর ধরে প্রস্তুতির পর চালু হওয়া এই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের শুরুটা তেমন ভালো হয়নি। শিক্ষাবর্ষ চালুর প্রায় দেড় মাসের মধ্যে দুটি শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করেছে সরকার। আরও তিনটি বই সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে ক্লাসেএখন ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে দলগতভাবে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে করানো হচ্ছে পড়াশোনা। গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে হাতে-কলমে শিক্ষায়। এতে সবাই সমানভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। নতুন কারিকুলাম যারা বুঝতে পারছে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, যারা বুঝতে পারছে না তারা ক্লাসের প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছে। শিক্ষকরাও বিষয়গুলো ঠিকঠাক খেয়াল করছেন না বলেও অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
গ্রুপভিত্তিক শেখা-কাজ করা হচ্ছে না। ৪৫ মিনিটের ক্লাসে পিছিয়ে পড়াদের চিহ্নিত করতে পারছেন না শিক্ষকরা। কেউ অনুপস্থিত থাকলে আগের বিষয় বোঝানো হয় না। লার্নিং লস ক্লাস করাতে রুটিনে বাড়তি ক্লাস যুক্ত করার চিন্তা।
এবিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, দুটি কারণে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়তে পারে। শিক্ষকরা ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলে ও সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে কোনো কোনো শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়তে পারে। গ্রুপওয়ার্কে সবাই একই রোল প্লে করবে, বিষয়টি আসলে তা নয়। শিক্ষকরা মৌখিকভাবে রোল ডিফাইন করে না দিলে বোঝাপড়ার গ্যাপ তৈরি হয়। সবাই একসঙ্গে প্রেজেন্টেশন দেবে না। প্রেজেন্টেশন তৈরিতে কে কী করবে সেটি আগে থেকে নির্দেশনা দেবেন শিক্ষক।
তিনি বলেন, এসব বিষয় যেহেতু চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে এটি একটি ভালো দিক। পরবর্তী সময়ে এসব বিষয়ে নতুন নির্দেশনা দেয়া যাবে। এতে শিক্ষার্থীরা আর কেউ ইনঅ্যাকটিভ থাকবে না।
এই শিক্ষাবিদ বলেন, কোনো শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস না করলে সে এমনিতে পিছিয়ে পড়তে পারে। সে কারণে সামনে ক্লাস রুটিনে রেমিডিয়াল ক্লাস যুক্ত করা হবে। যে বাচ্চারা এমন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে তাদের এক্সট্রা সাপোর্ট দিতে ও সেগুলো যেন রুটিন ওয়ার্কের মধ্যে থাকতে পারে সেজন্য রুটিনে অতিরিক্ত ক্লাস যুক্ত করা হবে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে ক্লাস রুটিনে লার্নিং লস বা রেমিডিয়াল (সংশোধনমূলক শিখন) ক্লাস করানোর কথা ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যারা পিছিয়ে পড়ছে তাদের চিহ্নিত করে আলাদাভাবে ক্লাস করানোর দায়িত্ব শ্রেণি শিক্ষকদের। সেটি করলে কেউ পিছিয়ে পড়বে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরা মডেল একাডেমির একজন শিক্ষক বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনার ভিত্তিতে আমরা কোনো শিক্ষার্থীকে জোর করে কিছু করাতে পারি না। ক্লাসে টিমওয়ার্ক করে কাজ করতে দেয়া হয়। তাতে যদি কেউ করতে না চায় তাকে বুঝিয়ে বলা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকে না।
তিনি আরো বলেন, টিম লিডারের তত্ত্বাবধানে টিমওয়ার্কের মাধ্যমে সবাইকে কাজ করার কথা থাকলেও ক্লাসের সব শিক্ষার্থী সমানভাবে বুঝতে পারে না। কেউ কেউ আবার হাতে-কলমে কাজ করতে চায় না, নানাভাবে ফাঁকি দিচ্ছে। এতে দলের কেউ কেউ এগিয়ে গেলেও কেউ কেউ পিছিয়ে যাচ্ছে। যারা নিজে থেকে এসে বলছে তাদের আলাদাভাবে কিছু কাজ দিয়ে তা বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হলেও অন্যরা পিছিয়ে পড়ছে। এতে বছর শেষে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষকরা।