করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে আগামী বিশ্ব বড় ধরণের কিছু পরিবর্তন দেখতে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করছে। অতি অধুনিক এবং সভ্য দেশকেই এটা ভাবাতে বাধ্য করছে যে তাদের এতদিনের এক্সিসটেন্সির ধারণা ভুল এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তিও প্রকৃতির কাছে ভঙ্গুর।
প্রথমেই আসি বাংলাদেশের ব্যাপারে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে সাধারণ মানুষ সমর্থন দিয়ে গেছে। তার আন্দোলনকে করেছে বেগবান। তার ডাকে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আগুনে ঝাপিয়ে পড়তে দ্বিধা করেনি। ৯ মাসের যুদ্ধে প্রায় সবার অংশগ্রহন ছিল কিছু বিশ্বাসঘাতক আর স্বার্থান্বেষী মহল বাদে।
আজ আমরা এক করুণ এবং দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। রাষ্ট্রের সকল মানুষকে একযোগে এই মরণঘাতি করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, যা চীন করে সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু, দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে কিছু মানুষ আক্রান্ত হবার ভয়ে হাসপাতাল স্থাপন করতে দিচ্ছে না, মৃতকে কবর দিতে দিচ্ছে না, সর্দি কাশি হলেই হাসপাতালে রোগির চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর খবর আসছে। উন্মোচন করছে কিছু শিক্ষিত নামধারী মূর্খের স্বার্থপর-চেহারা। বিষয়গুলো আমাদের একটি অংশের অমানবিকতাকেই তুলে ধরেছে। এমন কাজ জাতীয় দুর্যোগে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসের অন্তরায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ কাস্টমস এবং ব্যাংক অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কাজ করছে। পুলিশ, আনসার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন আইন শৃংখলা রক্ষায় কাজ করছে, চিকিৎসকগণ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবক শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ করোনা জরুরী সেবাদানকারীদের এক প্ল্যাটফর্মে এসে সম্মিলিতভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। এটা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে বিপদ-আপদে ইমিডিয়েট রেসপন্সের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।
এছাড়া, দেশের আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা সকলকে স্বাস্থ্য সচেতন করাচ্ছে যা ভবিষ্যতেও কাজে লাগবে যেভাবে ডায়রিয়া, অমাশয়ের প্রাদুর্ভাবের পর খোলা/কাচা টয়লেটের নেতিবাক দিকগুলো বাংলাদেশীদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল।
অন্যদিকে সারা বিশ্বে আজ হাহাকার পরস্থিতির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গোটাবিশ্বের নেতৃত্বকে এক প্ল্যাটফর্মে এসে সিদ্ধান্ত নেয়ার মানসিকতা তৈরি করেছে যা জাতিসংঘ তার ৭৫ বছরের ইতিহাসে করতে পারে নি। সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক কিংবা গাজায় প্রতিনিয়ন শক্তিশালী দেশের বোমা হামলায় হাজারো নিহতের খবর শোনা যাচ্ছে না। আজ বিশ্ব মোড়লেরা নিজেদের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত। সিরিয়া, ইরাক, গাজা, রোহিঙ্গা, জিনজিয়াং প্রদেশ কিংবা ইয়েমেনের স্থলে মৃত্যুর খবরে হেডলাইন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, চীন, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ইরান কিংবা পর্তুগাল। ২৯ মার্চ জিএমটি ১৭ঃ৩০ ঘটিকা পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬৯৭৬০৯ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৩৩১১৬ জন যা মোট আক্রান্তের ৪.৭৫%।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ মারাত্মক আকার ধারণ করলে প্রকৃতি নিজেই তার স্থান করে নেয়। প্রযুক্তির একচ্ছত্র প্রাধান্যকে ভঙ্গুর প্রমাণ করে দিয়ে নিজেই নিজের ক্ষতির রিকভারি করছে। কার্বন নিঃসরণকারী বড় বড় কারখানাগুলো অনেকটাই বন্ধ করা হয়েছে। The Centre for Research on Energy and Clean Air এর গবেষণা অনুযায়ী শুধু চীন গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২০০ মিলিয়ন টন গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন কমিয়েছে যার পরিমাণ ব্রিটেনের বার্ষিক নিঃসৃত গ্যাসের অর্ধেকের বেশি। উত্তর মেরুর বরফ গলার পরিমাণ কমেছে কিছুটা। বিমান চলাচলের সীমিত করা হয়েছে। অথচ বিশ্বে মোট কার্বনের ২.৫% বিমান কর্তৃক নিঃসৃত হয়। অনেক চেষ্টা করেও গত ১০০ বছরে গোটা বিশ্ব প্রকৃতির জন্য যা করতে পারে নি, বছরের পর বছর জলবায়ু সম্মেলন করে যে সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি, প্রকৃতি ঠিক সে যায়গাটি করে নিয়েছে।
আজ গাছে গাছে নতুন পাতা গজাচ্ছে। সমগ্র বিশ্বে সীসা, ধূলিকণা মুক্ত পরিষ্কার বাতাস বইছে। সমূদে সৈকতে পর্যটকদের উপস্থিতি শূন্যের কোঠায় আসায় ডলফিন, রাজকাকড়া কিংবা অন্যান্য সামূদ্রিক প্রাণীর অবাধ বিচরণ প্রাণ ফিরিয়ে এনেছে জীববৈচিত্র্যে। মানুষ ব্যক্তিগত কাজে জীবাস্ম জ্বালানী কমিয়ে দিয়েছে। তবে এ ভাইরাসের দীর্ঘ মেয়াদী কার্যকরিতা প্রকৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব রাখবে বলেই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের গবেষক মিহান ক্রিস্ট। রিনিউএবল এনার্জি তথা সোলার প্যানেল কিংবা উইন্ড টারবাইনের বেশিরভাগ যন্ত্র তৈরি হয় চীনে যার সাপ্লাই কমে গেছে। তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় তেল নির্ভর পাওয়ার জেনারেশন মেশিনগুলোর উপর নির্ভরতা বেড়ে যাবে। এই ওয়ার্ল্ড সাপ্লাই চেইনে বিঘ্নের দীর্ঘ মেয়াদ পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসবে।
এখন মানব চলাচল সীমিত করা হয়েছে। গত ১০০ বছরেও বিশ্ব এমনটি দেখে নি। থেমে গেছে যুদ্ধ, হানাহানি কিংবা ট্রাভেলারের ট্রাভেল। ধনী-গরিবকে এক কাতারে নিয়ে আসছে এই করোনা।
জিওপলিটিক্সের ক্ষেত্রে করোনা চীনকে এনে দিয়েছে এক নতুন দিগন্ত। আক্রান্ত দেশগুলোতে মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট ও মেডিকেল এসিসটেন্সির সহায়তা দিয়ে সৃষ্টি করছে নিজের গ্রহনযোগ্য অবস্থান। রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখা ইতালি রুশ-মেডিকেল ইকুইপমেনন্টের সহায়তা নিচ্ছে, কে শত্রু কে মিত্র, তা দেখার সময় হচ্ছে না পশ্চিমা বিশ্বের।
এ শতাব্দিতে বিশ্ব রাজনীতির হিসেব নিকেশ চেঞ্জ হয়েছিল ৯/১১ এর পর। সবচেয়ে নিরাপদ রাষ্ট্রটিও তাদের আগের ভাবনা থেকে বের হয়ে আসছে, যে তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। এবার করোনার কারনে আরেকটি পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। বিশ্ব বড় ধরণের অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উপর প্রাধান্য বিস্তারে ধাক্কা লেগেছে।
সর্বোপরি, করোনা মহামারি থেকে উত্তরণের পর আশা করা যাচ্ছে, বিশ্বে নতুন ধারায় গবেষণা হবে। বড়দের দাম্ভিকতা কমে যাবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে পলিসি মেকাররা এক হয়ে কাজ করবে। COP-25 এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের ক্লাইমেট ফান্ড তৈরিতে কার্বন নিঃসরনে দায়ী বড় দেশগুলো এগিয়ে আসবে।
এসব নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের ভাবনা কি হবে, বিশ্বকে বসবাসযোগ্য রাখবে কিনা, টেকসই উন্নয়নে তাদের ভূমিকা প্রকৃতপক্ষে কি হবে এগুলো দেখতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
মোঃ হাফিজুর রহমান শিকদার
সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা
উত্তরা ইপিজেড, নীলফামারি।
Post Views: ৩৭৮